লেবু বাংলাদেশের একটা জনপ্রিয় ফল। প্রতিদিনের খাবার টেবিলে লেবু ছাড়া যেন আমাদের খাবার পরিপূর্ণ হয় না। লেবুতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি আছে। লেবুর মধ্যে টক লেবু আছে, মিষ্ট লেবু আছে, আছে বাতাবীলেবু, সাতকড়া লেবু, জারা লেবু ইত্যাদি। ছাদ বাগানের টবে বা পটে সব ধরনের লেবুই চাষ করা সম্ভব। লেবুর কিছু জনপ্রিয় জাত সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতে পারি। লেবু নামটা এসেছে সংস্কৃত ‘নিম্ন’ থেকে। নিম্ন থেকে নিমু পরিশেষে হয়েছে লেবু। লেবু নামটা যত সহজ, ফলটা তত সহজ নয়। এদেশে সিলেটেই আছে প্রায় আশি রকমের লেবু। এক এক লেবুর আকার-আকৃতি ও স্বাদ ভিন্ন রকম- কোনটা ভীষণ টক, কোনটা আবার ভীষণ মিষ্টি। সাধারণভাবে টকজাতীয় বা সাইট্রাসজাতীয় ফল বলা হয় লেবুকে। সব লেবু টক নয়। সুইট অরেঞ্জ, মাল্টা, কমলা, চাইনীজ কমলা- এসব মিষ্টি স্বাদের লেবু।
অন্যদিকে কালামুন্সি, কাগজি, এলাচিলেবু- এসব টক স্বাদের। বাতাবী লেবু টক-মিষ্টি। ঘ্রাণের দিক দিয়েও এক এক লেবুর ঘ্রাণ এক এক রকম। লেবুতে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারণেই লেবুর এত ভিন্নতা। কাজেই ভেষজগুণ যেসব লেবুর একই রকম সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কবি কালিদাসের একটা হেঁয়ালি মনে পড়ছে- ‘বন থেকে বেরুলো পেতি, পেতি বলে আমি তোর পাতে মুতি।’ পাতে অর্থাৎ ভাতে মুততে সব লেবু পারে না। কাগজিলেবুর আর এক নাম পাতিলেবু- পাতিলেবুকেই মনে হয় কালিদাস বলেছেন পেতি। পাতে মুতায় কাগজিলেবুর অধিকার অগ্রগণ্য। এখানে তাই কাগজি লেবুকে আমিও অগ্রাধিকার দিলাম আলোচনায়। শুধু আমি কেন, এই করোনাকালে সবাই এখন লেবুকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। নানাভাবে লেবু খাওয়ার অভ্যাস করছেন।
এক্ষেত্রেও স্বাদে-গন্ধে-উপকারে কাগজিলেবু সেরা। লেবুর মধ্যে কাগজিলেবু তুলনামূলকভাবে ছোট বলে এর অন্য নাম হয়েছে পাতিলেবু। আবার পাত মানে ভাত খাওয়ার থালায় এর ব্যবহার রয়েছে বলেও এর নাম পাতি লেবু হতে পারে। ছোট হলেও কাগজি লেবুর যে সুঘ্রাণ তা আর কোনো লেবুতে নেই। এ লেবুর গাছ খুব বড় হয় না, ডালপালা কিছুটা লতানো ও ঝোপালো, কাঁটাময়। পাতা ডিম্বাকার ও ছোট, চকচকে সবুজ। ফুলের রং সাদাটে। কাগজিলেবু লম্বাটে, খোসা মসৃণ ও পাতলা, সবুজ ও চকচকে। খোসায় নখের আঁচড় দিলে কাগজিলেবুর বিশেষ ঘ্রাণ পাওয়া যায়, যা অন্য কোনো লেবুতে পাওয়া যায় না। প্রায় সারা বছরই গাছে ফুল ফল ধরে। তবে মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বেশি লেবু ধরে। কাগজিলেবু অম্লরসযুক্ত। ভেতরের কোষ হালকা সবুজাভ সাদা ও রসে পরিপূর্ণ থাকে। পরিণত হলে বেশি রস হয়। ভেতরে স্বল্প বীজ হয়। বর্তমানে বীজবিহীন জাতও উদ্ভাবন করা হয়েছে। কাগজিলেবুতে উচ্চমাত্রায় অ্যাসকরবিক এসিড বা ভিটামিন সি, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া রয়েছে অধিক পরিমাণে পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম খনিজ দ্রব্য যা দেহের স্নায়ুর চালিকাশক্তি বৃদ্ধি করে। আরও আছে কিছু
অ্যাসেনসিয়াল অয়েল। এই তিন ধরনের রাসায়নিক যৌগসমূহ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্লাভিনয়েডস, ফেনল, কুমারিনস, ট্যানিন, অ্যালকালয়েড, লাইকোপেন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, লিপিড ইত্যাদি যৌগগুলোর সাথে মিলে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব উপাদানগুলোর কারণে কাগজিলেবু অ্যান্টিসেপটিক, কৃমিনাশক, ছত্রাক জীবাণুনাশক, ব্যাকটেরিয়া জীবাণুনাশক, ভাইরাস জীবাণুনাশক, অ্যান্টিক্যানসার হিসেবে ও আন্ত্রিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে থাকে। কাগজিলেবু বয়স ধরে রাখতে বা দেহের তারুণ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমাদের ছাদ বাগানে যেসব লেবুর চাষ করতে পারি তাদের মধ্যে অন্যতম হলো: কাগজিলেবু বা পাতিলেবু; বারি লেবু-১ বা এলাচি লেবু (এলাচের মতো একটু সুগন্ধ পাওয়া যায়); বারি লেবু-২ (গোলাকার কাগজিলেবু); বারি মিষ্টি লেবু-১ (মিষ্টি লেবু মাল্টা ও বাতাবীলেবুর মতোই সুস্বাদু); বারি বাতাবীলেবু ১,২,৩ ও ৪; বারি মাল্টা-১ (বেশ সুস্বাদু) ইত্যাদি। এসব লেবু আমরা আমাদের ছাদ বাগানে চাষ করতে পারি।
চিত্র: বিভিন্ন প্রকারের লেবু।
ছাদে লেবুজাতীয় ফলের চাষ পদ্ধতি : ছাদে লেবুজাতীয় ফলের চারা কলম চারা লাগানোর জন্য হাফ ড্রাম অথবা সিমেন্টের পট বা জিও ব্যাগ নিয়ে তাতে এই বইয়ের “ছাদ বাগানের জন্য মাটি প্রস্তুত ও চারা রোপণ” অধ্যায়ে ছাদ বাগানের জন্য “ছাদ বাগানের জন্য আদর্শ মাটি তৈরি করত সেখানে লেবুজাতীয় গাছের কলম রোপণ করতে হবে। চারা গাছটিকে সোজা করে সঠিকভাবে রোপণ করতে হবে। তারপর গাছের গোড়ায় মাটি কিছুটা উঁচু করে হাত দিয়ে মাটি চেপে চেপে দিতে হবে। ফলে গাছের গোড়া দিয়ে পানি বেশি ঢুকতে পারবে না। একটি সোজা চিকন লাঠি দিয়ে গাছটিকে বেঁধে দিতে হবে। চারা রোপণের শুরুর দিকে পানি অল্প দিলেই চলবে। পরে ধীরে ধীরে পানি দেওয়া বাড়াতে হবে। তবে গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না। মাটিতে রসের ঘাটতি দেখা দিলে প্রয়োজনমতো গাছে সেচ দিতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা : বিভিন্ন পরিচর্যা সহ প্রতিবছর দু’বার সার প্রয়োগের জন্য “ছাদ বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা” অধ্যায়ের খুঁটিনাটি অনুসরণ করুন।
লেবুর পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন:
লেবুজাতীয় ফলে বেশ কিছু পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ দেখা যায়। সুতরাং, ছাদ বাগানীদের এ ব্যাপারে একটা ধারণা থাকা আবশ্যক।
লেবু গাছের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা :
পূর্ণাঙ্গ মথের দেহ অনুজ্জ্বল ধাতব সবুজ থেকে গাঢ় বেগুনি। উপরের পাখার মধ্যভাগে লম্বালম্বিভাবে হলদে ছিট আছে। এদের শুঙ্গ প্রায় শরীরের সমান। কাণ্ডে কীড়ার রং হলুদ। এই পোকার কীড়া লেবু গাছের ডগায় ছিদ্র করে। আক্রান্ত ডগা মরে গেলে কীড়া দিক পরিবর্তন করে নিচের দিকে নেমে গাছের বড় বড় শাখায় সুড়ঙ্গের সৃষ্টি করে এবং মাঝে মাঝে গর্ত খুঁড়তে থাকে। সুড়ঙ্গ মুখে একপ্রকার আঁঠালো পদার্থ বের হয়। আক্রান্ত ডগা আস্তে আস্তে কালো হয়ে মরে যায়। ডগা মারা যাওয়ার পর কীড়া প্রধান কাণ্ডে সুড়ঙ্গের সৃষ্টি করে। ফলের বাড়ন্ত পর্যায় ফলের যে অংশে আক্রমণ করে। পোকার কীড়া, নিম্ফ ক্ষতি করে। লেবু গাছের কান্ড ছিদ্রকারী পে
চিত্র: লেবু গাছের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা
ব্যবস্থাপনা : আক্রমণ বেশি হলে থায়ামিথক্সাম+ক্লোথায়ারানিলিপ্রল জাতীয় কীটনাশক অথবা সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ডগায় স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর, ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
লেবুর সাইলিড পোকা : ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায় এবং মরশুমের সময়ের ওপর নির্ভর করে, সাইট্রাস সাইলিডের আক্রমণ বিভিন্ন হয়। পোকার কীড়া ও বয়স্ক পোকা ফসলের মুকুল, ফুল, কচি শাখা এবং ছোট ছোট ফল খেয়ে নষ্ট করে। এরা যখন চিনিসমৃদ্ধ রস খায় তখন মধুর ন্যায় তরল নিঃসৃত করে, যার ফলে শুটিমোল্ড তৈরি হয় যা সালোকসংশ্লেষণের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। অবশেষে, পোকার সংখ্যা বেশি হলে, কচিপাতা প্যাঁচিয়ে কুঁচকে যায় এবং কাণ্ডের দৈর্ঘ্য কমে যাওয়ার ফলে ফসলের চারা খাটো দেখায়। অধিক সংখ্যক পোকা কমবয়সি গাছের বৃদ্ধিকে রোধ করে এবং উল্লেখযোগ্য হারে ফলন হ্রাস করে। এ পোকা অত্যন্ত ক্ষতিকারক হতে পারে, কারণ এটি লেবুর গ্রিনিং রোগের একটি প্রধান বাহক হিসেবে কাজ করে।
চিত্র: লেবুর সাইলিড পোকা
ব্যবস্থাপনা:
উষ্ণ, শুষ্ক আবহাওয়ায় পোকার সংখ্যা কম থাকলে শিকারি পোকা এবং পরজীবী পোকা এদের ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে পরজীবী বোলতা টামারিক্সা রেডিয়েটা বা সাইলিওফেগাস ইউফাইলিউরি। শিকারি পোকার মধ্যে রয়েছে এন্থোকরিস নেমোরালিস নামক পাইরেট গান্ধি পোকা, ক্রাইসোপারলা কারনেয়া লেইসউইং এবং কক্কিনেলা সেপ্টেম্পাঙ্কটাটা বিটল পোকা। পোকার নিক্ষপ্রতিরোধী মোম জাতীয় উপাদান নিঃসরণের আগে নিমের তৈল বা হর্টিকালচারাল তৈল ব্যবহার করে পোকা দমন করুন। সম্ভব হলে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার আওতায় জৈবিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সর্বদা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিন।
ডাইমেথোয়েট সংগঠিত উপাদানের বালাইনাশক সাইলিডের বিরুদ্ধে কার্যকর, তবে শুধুমাত্র শেষ অবলম্বন হিসেবে তা ব্যবহার করা উচিত। মোম জাতীয় উপাদান যা প্রতিরোধী উপাদান হিসেবে কাজ করে তা নিঃসরণের আগে বালাইনাশক প্রয়োগ করুন। মনে রাখবেন, অতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহারে সাইলিড ও অন্যান্য পোকা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। বয়স্ক পোকা যাতে গাছের ওপরে নিচে পালাতে না পারে সেজন্য গাছের বাকলে ডাইমেথোয়েটের (০.০৩ শতাংশ) পেস্ট মেখে দিন। সাইট্রাস সাইলিড (ডায়াফরিনা সাইট্রি) নামক পোকার খাদ্য গ্রহণের কারণে রোগের উপসর্গ দেখা যায়। বয়স্ক পোকা ৩ থেকে ৪ মিমি দীর্ঘ হয় এবং মাথা ও ঘাড় বাদামি কালো রঙের হয়। এদের উদর হালকা বাদামি এবং ছোপ ছোপ ঝিল্লিযুক্ত পাখা থাকে। এরা গাছের কাণ্ডে বা পরিণত পাতায় আশ্রয় নিয়ে শীতাবস্থা কাটায়। একটি বয়স্ক সাইলিড পোকার গড় আয়ু তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এদের জন্য সর্বোত্তম সহায়ক। শীতল আবহাওয়া এদের দীর্ঘ জীবনকে ত্বরান্বিত করে এবং উষ্ণ তাপমাত্রা এদের জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে। স্ত্রী পোকা বসন্তে
নতুন কুঁড়ি এবং শাখায় ৮০০ কমলা রঙের ডিম পাড়ে। কীড়া চ্যাপ্টা এবং সাধারণত হলুদ রঙের হয় এবং এরা সাদা মোম জাতীয় উপাদান নিঃসৃত করে যা এদের সুরক্ষা দেয়। সাদা সুতা বা মোম জাতীয় উপাদানের কারণে এদের জাবপোকা থেকে আলাদা করা যায়। আঘাতপ্রাপ্ত হলে কীড়া বয়স্ক পোকার তুলনায় কম দূরত্ব অতিক্রম করে। ক্ষতিগ্রস্ত কোষকলা ফসলের অন্যান্য অংশে পুষ্টি উপাদান বিতরণে অক্ষম হয়ে পড়ে।
ব্যবস্থাপনা:
- বসন্তের শুরুতে সাইলিড পোকার লক্ষণ শনাক্ত করতে নিয়মিত জমি তদারকি করুন।
- বয়স্ক পোকা ধরতে পরামর্শ অনুযায়ী আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করুন।
- চারা রোপণের সময় চারা থেকে চারার পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখুন।
- উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বালাইনাশক মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে উপকারী পোকার ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকুন।
- সাইলিড পোকার সহায়ক পরিবেশ রোধ করতে ফসলের পাতায় পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস প্রবেশ নিশ্চিত করুন।
- মরশুমজুড়ে অতিরিক্ত সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকুন।
লেবুর মাকড় : পূর্ণবয়স্ক লাল মাকড় খুবই খুদে, সাধারণত খালি চোখে দেখা যায় না। এরা ছোট দল বেঁধে পাকার নিচে থাকে। ডিম্বাকার, পুরু, ০.৫ মিমি লম্বা, ৪ জোড়া পা। সাদা, হলদে বা লাল ধরনের। পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা মাকড় একটি শাখার কচিপাতায় আক্রমণ করে ও পাতার রস চুষে নেয়। পাতা ভিতরের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়। বাড়ন্ত পর্যায়, ফলের বাড়ন্ত পর্যায়ে পাতায় আক্রমণ করে। পূর্ণবয়স্ক, নিম্ফ উভয়ে ক্ষতি করে। লোয় মাকড
চিত্র: লেবুর মাকড়
লেবুর মাকড় ব্যবস্থাপনা : আক্রমণ বেশি হলে কার্বেন্ডাজিম অথবা ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করুন।
লেবুর পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা : গাছের যেকোনো পর্যায়ে আক্রমণ হতে পারে তবে প্রধানত পাতায় এর আক্রমণ দেখা যায়। প্রথমে লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় পাতা বিকৃত হয়ে বেঁকে বা কুঁচকে যায়, যদিও পাতা সবুজ থাকে। পাতার দুটি ত্বকের মধ্যবর্তী স্থানে সাদা বা ধূসর সুড়ঙ্গ দেখা যায়। সুড়ঙ্গের ভিতরে গাঢ় পাতলা দাগ দেখা যায় (কীড়ার উছিষ্টাংশের কারণে), যা পাতার নিচ থেকে সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। সুড়ঙ্গের ভিতরের শেষ মাথায় কীড়ার উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এবং প্রতিটি পাতায় কয়েকটি কীড়া থাকতে পারে। আক্রান্ত পাতায় আক্রমণকারী ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। আক্রমণ ব্যাপক হলে সালোকসংশ্লেষন কমে যায়, ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফলের আকার ও মান নষ্ট হয়। আক্রমণ খুব বেশি হলে পুরো গাছের সব পাতা ঝরে যেতে পারে, ফলে গাছ মারা যায়। লেবুর পাতার সুড়ঙ্গকারী পোকা পাইলোনিস্টিস সাইট্রিলা, পাতা খেয়ে ক্ষতি সাধন করে। বয়স্ক পোকা দেখতে ছোট, বাদামি বা ধূসর রঙের হয় যাতে কাঁটাযুক্ত ডানা থাকে এবং সামনের ডানার ওপরে একটি স্পষ্ট গাঢ় দাগ থাকে। এরা সকাল ও সন্ধ্যায় ঠান্ডা তাপমাত্রায় সক্রিয় থাকে এবং ভোরে ও রাতেও সক্রিয় থাকতে পারে। বসন্তে স্ত্রী পোকা পাতার নিচের পৃষ্ঠে ডিম পাড়ে। সদ্য ফোটা কীড়া দেখতে স্বচ্ছ সবুজ বা হলুদ দেখায় এবং এরা প্রধানত পাতা খায়, তবে মাঝে মাঝে ফলেও আক্রমণ করে। পাতার দুটি ত্বকের মধ্যবর্তী স্থানে সাদা বা ধূসর সুড়ঙ্গ তৈরি করে। কীড়ার শেষ পর্যায়ে এরা সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে আসে এবং নিকটস্থ পাতা প্যাঁচিয়ে পুত্তলি অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়। এটি সব লেবু উৎপাদন এলাকার জন্য খুব পরিচিত একটি পোকা। তাছাড়া, এর কারণে অন্যান্য রোগ যেমন ব্যাকটেরিয়া ক্ষতরোগ বেড়ে যায়।
বালাই ব্যবস্থাপনা : শিকারি পোকার মধ্যে রয়েছে নিউরন্টেরা অন্তর্ভুক্ত সবুজ লেইস উইং পোকা। এছাড়া অনেক ধরনের পরজীবী বোলতা এদের আক্রমণ করতে পারে এবং কীড়া খেয়ে ফেলে, যার মধ্যে অন্যতম টেট্রাস্টিকাস। লেবুর পাতার সুড়ঙ্গকারী পোকা দমন করতে স্পিনোস্যাড, মাছের তেল, রেজিন সাবান এবং পঙ্গামিয়া তেল সংগঠিত উপাদানের জৈব বালাইনাশক হিসেবে পাতায় ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পোকা যাতে পাতায় ডিম না পাড়তে পারে সেজন্য নিমতেলও ব্যবহার করা যায়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :
- লেবুর পাতার সুড়ঙ্গকারী পোকা প্রতিরোধী জাত নির্বাচন করুন।
- পোকার আক্রমণ শনাক্ত করতে নিয়মিত বাগান তদারকি করুন, বিশেষ করে পাতার নিচের অংশ।
- পোকা আকৃষ্ট করতে ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করুন।
- গাছের চারপাশে জমিতে বিলি গট আগাছা (এগারাটাম কনিজয়েড) লাগিয়ে দিন।
- পোকা যাতে লুকিয়ে থাকতে না পারে সেজন্য শীতকালে ঝরাপাতা সরিয়ে ফেলুন।
- উপকারী পোকাদের ক্ষতি করে এমন মাত্রার বালাইনাশক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
- গাছ ছাঁটাই করুন যাতে পোকার আক্রমণের সময় গাছের নতুন শাখা বের না হয়।
- নিয়মিত পার্শ্ব কুশী কেটে ফেলুন।
লেবুতে সুড়ঙ্গকারী পোকার আক্রমণ হলে বালাইনাশক খুব একটা কাজ করে না, কারণ পোকা পাতার ত্বকের ভিতরে অবস্থান করে। যদি বালাইনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে তবে বয়স্ক পোকা যখন বের হয় তখন আন্তঃপরিবাহী ও স্পর্শক বালাইনাশক ব্যবহার করুন। অ্যাম্বামেকটিন টিউবোফেনোজাইড, অ্যাসিটামিপ্রিড, ডাইফ্লুবেঞ্জিরোন বা স্পাইনোটোরাম নামক কয়েকটি বালাইনাশক পাওয়া যায়। এ পোকা দমনে সিন্থেটিক পাইরিথ্রয়েডও ব্যবহার করা যায়।
লেবুর ছাতরা পোকা : ৩-৪ মিমি আকারের গোলাপি রঙের, ডিম্বাকার পেটের দিক খাঁজ কাটা। গায়ে সাদা তুলার মতো আবরণ থাকে। এরা দল বেঁধে থাকে। এরা পাতা ও ডালের রস চুষে নেয়, ফলে গাছ দুর্বল হয়। পোকার আক্রমণে পাতা, ফল ও ডালে সাদা সাদা তুলার মতো দেখা যায়। অনেক সময় পিঁপড়া দেখা যায়। এর আক্রমণে অনেক সময় পাতা ঝরে যায় এবং ডাল মরে যায়।
চিত্র: লেবুর ছাতরা পোকা
ব্যবস্থাপনা:
ফল সংগ্রহ শেষ হলে গাছের মরা ডালপালা, ফলের বোঁটা, রোগ বা পোকা আক্রান্ত ডালপালা ও অতি ঘন ডালপালা ছাঁটাই করে পরিষ্কার করে দিন। এই পোকা দমনের জন্য ল্যামিক্স ২৪.৭ এস সি ১০ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে সম্পূর্ণ গাছে ভালোভাবে স্প্রে করুন। ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। লেবুজাতীয় ফলের রোগবালাই ব্যবস্থাপনা :
লেবুর ঢলে পড়া রোগ : এ রোগ দেখা দিলে গাছ মরে যেতে শুরু করে। এক সময় পুরো গাছ মরে যেতে দেখা যায়। এ রোগটি ছত্রাকের আক্রমণে হয়।
চিত্র: লেবুর ঢলে পড়া রোগ
ব্যবস্থাপনা:
১. সুষম মাত্রায় জৈবসার ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা এবং নিয়মিত সেচ প্রদান করা। বাগান সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখুন। ফল সংগ্রহ শেষ হলে গাছের মরা ডালপালা, ফলের বোঁটা, রোগ বা পোকা আক্রান্ত ডালপালা ও অতি ঘন ডালপালা ছাঁটাই করে পরিষ্কার করে দিন।
২. আক্রান্ত গাছ বাগান থেকে অপসারণ করা।
৩. প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে বোর্দো মিশ্রণ বা কপার অক্সিক্লোরাইট জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন- কুপ্রাভিট ৪ গ্রাম / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
৪. নতুন পাতা বের হলে ব্যাভিস্টিন ১ গ্রাম / লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করা।
লেবুর পরগাছা সমস্যা : পরগাছা গাছের গায়ে জড়িয়ে থেকে গাছের পুষ্টিতে ভাগ বসায় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত করে গাছের ক্ষতি করে।
চিত্র: লেবুর পরগাছা সমস্যা
দমন ব্যবস্থাপনা : ফুল আসার আগেই পরগাছা গাছ থেকে মূল/শিকড়সহ অপসারণ করে ধ্বংস করা। আক্রান্ত ডাল আপসারণ করা। বাগান অপরিচ্ছন্ন রাখবেন না। পরগাছা বা পরগাছা বীজমুক্ত চারা/বীজ লাগান। নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করুন।
লেবুজাতীয় গাছের সাইট্রাস গ্রিনিং রোগ (Citrus greening) : এ রোগ মাইকোপ্লাজমা সাইট্রি (Mycoplasma citri) নামক মাইকোপ্লাজমার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। Psyliid bug দ্বারা এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ রোগ সব ধরনের লেবুজাতীয় ফসলেই হয়ে থাকে। পাতা হলুদ হয়ে যায়। শিরা ও উপশিরাগুলো ক্রমশ
গাঢ় সবুজ হতে থাকে, যার জন্য রোগের নাম সাইট্রাস গ্রিনিং হয়েছে। শিরা দুর্বল ও পাতা কুঁকড়িয়ে ডাই-ব্যাক এর সৃষ্টি করে। পাতা ও গাছ খর্বাকৃতির হয়। ফলে রোগ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের ফল ছোট হয়। ফলে রসের পরিমাণ কমে যায়।
রোগের প্রতিকার : নীরোগ বীজতলার চারা ব্যবহার করতে হবে। বাগান পরিষ্কার পরিচছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। Psyliid bug দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক (যেমন- অ্যাডমায়ার বা ইমিটাফ) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
লেবুর পাউডারী মিলডিউ : রোগের কারণ ছত্রাক। পাতায়, কচি ডগা বা ফলে সাদা পাউডারের মতো বস্তু দেখা যায়। গাছ মরে যেতে শুরু করে এক সময় পুরো গাছ মরে যেতে দেখা যায়। ফলের বাড়ন্ত পর্যায়ে আক্রমণ করে। পাতা, ডগা, ফল আক্রমণ করে।
ব্যবস্থাপনা : সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: গোল্ডাজিম বা এমকোজিম ১০ মিলি) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
লেবুর লাল মরিচা রোগ :
রোগের কারণ : এক ধরনের সবুজ শৈবাল।
ক্ষতির লক্ষণ : পাতায়, ফলে ও কাণ্ডে লালচে মরিচার মতো একধরনের উঁচু দাগ দেখা যায়।
ক্ষতির ধরন : পাতায়, ফলে ও কাণ্ডে লালচে মরিচার মতো একধরনের উঁচু দাগ দেখা যায়।
ফসলের যে পর্যায়ে আক্রমণ করে : বাড়ন্ত পর্যায়, ফলের বাড়ন্ত পর্যায় ফসলের যে অংশে আক্রমণ করে পাতা, ডগা, ফল।
ব্যবস্থাপনা :
কপার অক্সিক্লোরাইট জাতীয় (কুপ্রাভিট ৪০ গ্রাম, ডিলাইট ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন অথবা খইলের সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করুন। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
লেবুর স্ক্যাব বা দাদ রোগ :
রোগের স্থানীয় নাম: দাদ রোগ
রোগের কারণ: ছত্রাক
ক্ষতির ধরন : উঁচু দাগ পড়ে কখনও কখনও পাতা ও ফলে দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত পাতার নিচের দিকে স্পর্শ করলে খসখসে লাগে। লেবুর পাতায় সুড়ঙ্গকারী পোকার আক্রমণ এ রোগ ডেকে আনে। ফসলের যে পর্যায়ে আক্রমণ করে বাড়ন্ত পর্যায়, ফলের বাড়ন্ত পর্যায়। ফসলের যে অংশে আক্রমণ করে পাতা, ফল।
চিত্র: লেবুর স্ক্যাব বা দাদ রোগ
ব্যবস্থাপনা : কপার অক্সিক্লোরাইট জাতীয় (কুপ্রাভিট ৪০ গ্রাম) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
লেবুর শুটিমোল্ড রোগ:
রোগের কারণ : ছত্রাক। মিলিবাগ বা জাবপোকা বা সাদা মাছির আক্রমণ। ক্ষতির ধরন: পাতায়, ফলে ও কাণ্ডে কালো ময়লা জমে। মিলিবাগ বা সাদা মাছির আক্রমণ এ রোগ ডেকে আনে। ফসলের যে পর্যায়ে আক্রমণ করে বাড়ন্ত পর্যায়, ফলের বাড়ন্ত পর্যায়। ফসলের যে অংশে আক্রমণ করে কাণ্ড, পাতা, ফল।
ব্যবস্থাপনা :
আক্রমণ বেশি হলে প্রপিকোনাজল জাতীয় ছত্রাকনাশক (টিল্ট ২৫০ইসি ৫মিলিলিটার) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চারা/কলমের প্রাপ্তিস্থান : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টারসমূহ, বিএডিসি’র এগ্রো সার্ভিস সেন্টার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে ভালো জাতের লেবুজাতীয় ফলের চারা/কলম পাওয়া যায়। আবার বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছ থেকেও এসব চারা/কলম সংগ্রহ করতে পারেন।
আমাদের ফেসবুক পেজ = Siraj Tech Facebook
গাছের জন্য বিভিন্ন জৈব কীটনাশক। 👉 Organic Fertilizers and Pesticides
ছাদ বাগান করার জন্য জিও ব্যাগের অর্ডার করতে 👉 Geo Grow Bag
দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন ধরনের সুন্দর সব ফল ও শাক-সব্জির বীজ পাবেন আমাদের কাছে। 👉 High Quality Gardening Seeds
ছাদ বাগানের বিভিন্ন সরঞ্জাম। 👉 High Quality Gardening Tools
নদী ও পুকুরের পাড় ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাগ ও জিও রোল। 👉Geobag Geotube and Geosheet