রোগ
উদ্ভিদের রোগ বলতে উদ্ভিদের দেহক্রিয়ার মধ্যকার গোলযোগকে বোঝায়। এই গোলযোগ দেখা দিলে উদ্ভিদের দেহের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এসবের ফলে অনেক সময় উদ্ভিদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। উদ্ভিদের রোগে সকল উদ্ভিদের মৃত্যু না হলেও বিভিন্ন হারে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রোগের জন্য এ ক্ষতির পরিমাণ ১০-১৫ ভাগ। এ ছাড়া রোগাক্রান্ত ফল ফসলের বাজারমূল্য অনেক কমে যায়। আবার রোগাক্রান্ত খাবার খেলে অনেক সময় মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
উদ্ভিদ রোগের কারণ
ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শৈবাল, পরগাছা, মাইকোপ্লাজমা, নেমাটোড, পোকামাকড় ইত্যাদি। ব্যাকটেরিয়া: ব্যাকটেরিয়া এককোষী কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবুজ কণাবিহীন। এদের দেহে এক বা একাধিক ফ্লাজেলা থাকতে পারে এবং এরা কখনো কখনো স্পোর তৈরি করে। এরা মৃতজীবী, পরজীবী, বায়ুজীবী এবং অবায়ুজীবী। এরা গোলাকার, লম্বাটে, কমা বা প্যাঁচানো আকারের হতে পারে।
ছত্রাক
এরা সবুজ কণাবিহীন। এদের কোনো কাণ্ড, শিকড় ও পাতা নেই। এরা নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে না। এ কারণে এরা মৃতজীবী, পরজীবী ও মিথোজীবী। এদের দেহ এককোষী, শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট, সুতাকৃতি ও বহুকোষী। এরা চলাফেরা করতে পারে না। যৌন অযৌন উভয়ভাবে বংশ বিস্তার করতে পারে।
মাইকোপ্লাজমা
মাইকোপ্লাজমা ক্ষুদ্রতম ব্যাকটেরিয়া অপেক্ষা অনেক ছোট এবং আলোক মাইক্রোস্কোপে দেখা যায় না। এদেরকে জীবজগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কোষ বলা যেতে পারে। এদের দেহে কোষপ্রাচীর না থাকলেও তিনস্তর বিশিষ্ট প্লাজমা মেমব্রেন আছে। এরা দ্বি-ভাজন, স্পোর উৎপাদনের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। এরা পরজীবী বা অপরজীবী।
নেমাটোড
এদেরকে কৃমিও বলে। এরা খুব ছোট আকারের জীব, দেখতে মুলা, নাশপতি, লেবু, লাটিম বা সুতার ন্যায়। এদের মুখ, পাকস্থলী ও লেজ আছে। এদের মুখে বর্শার মতো স্টাইলেট নামের একটা সূচালো অঙ্গ থাকে, যার মাধ্যমে গাছ থেকে রস শোষণ করে। স্ত্রী কৃমি, পুরুষ কৃমি থেকে বড় এবং একসাথে ৫০০-৩০০০টি ডিম পাড়তে পারে।
সপুষ্পক উদ্ভিদ
এরা এক ধরনের উদ্ভিদ, সম্পূর্ণ পরজীবী (স্বর্ণলতা) এবং আংশিক পরজীবী (লোরান্থাস)।
শেওলা
এদের দেহে ক্লোরোফিল আছে। এদের দেহ মূল, কাণ্ড ও পাতায় বিভক্ত নয়। এরা সরাসরি রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। তরে এরা ছত্রাকের সাথে জন্মে পাতা, কাণ্ড ও ডালে সালোকসংশ্লেষণে ব্যাঘাত করে।
ভাইরাস
এদের আকৃতি বিভিন্ন ধরনের। হতে পারে গোলাকার, সুতাকৃতি, বহুভুজাকৃতি। অতি ক্ষুদ্র। এদের দেহে থাকে নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA & RNA)। এরা জীবিতও না আবার মৃতও না, এরা এ দুয়ের মাঝামাঝি একটা সত্তা। রোগের
অজীবীয় কারণ
মাটি : গঠন, আর্দ্রতা, অম্লত্ব, ক্ষারত্ব, জৈব বিষ ইত্যাদি।
আবহাওয়া
বাতাসের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, গতিবেগ, আলোর পরিমাণ, বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি, তুষারপাত, বরফ, শিল্প নিঃসৃত গ্যাস ইত্যাদি।
রাসায়নিক পদার্থ
বালাইনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি।
রোগের বিস্তার
বীজ, মাটি, পানি, বাতাস, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, কৃষি যন্ত্রপাতি, পরিবহন ইত্যাদির মাধ্যমে উদ্ভিদের রোগ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিস্তৃত হয়ে থাকে।
উদ্ভিদ রোগের লক্ষণ
- নেক্রোটিক
- হাইপারপ্লাস্টিক
- হাইপোপ্লাস্টিক
নেক্রোটিক লক্ষণ
উদ্ভিদ বা উদ্ভিদ কলার মৃত্যুজনিত লক্ষণকে নেক্রোটিক লক্ষণ বলে। এ লক্ষণের ফলে গাছের আক্রান্ত অংশ মরে পচে বাদামি রং ধারণ করে যাকে বলে নেক্রোসিস। নেক্রোসিসের কতকগুলো সুস্পষ্ট লক্ষণ নিচে বর্ণনা করা হলো:
দাগ (Spot)
বিভিন্ন ধরনের দাগ হয়ে থাকে। সীমিত এই দাগগুলো বৃত্তাকার ও উপবৃত্তাকার। এ দাগ কখনো শুকনা আবার কখনো ভেজা ধরনের (বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ)। কখনো দাগের ভেতরে ও বাইরে নানান বর্ণের দাগ হতে পারে।
মরিচা (Rust)
পাতা ও কাণ্ডে লোহার মরিচার মতো দাগ পড়ে।
ব্লাইট (Blight)
উদ্ভিদের দ্রুত মৃত্যু হওয়াকে ব্লাইট বা মড়ক বলে। আক্রান্ত অং অনেকটা ঝলসানো মনে হয়।
ক্যাঙ্কার (Canker)
এ রোগে গাছের ছাল বা বাকল নষ্ট হয়ে কাণ্ডের ভেতরের কাঠ বেরিয়ে আসে। ক্ষতের চারপাশে কিছুটা উঁচু হয়ে যায়।
আগামরা (Die back)
গাছের আগার দিক থেকে শুরু করে নিচের দিকে নেমে আসে।
ড্যাম্পিং অফ বা নেতিয়ে পড়া (Damping off)
চারা মাটি সংলগ্ন জায়গার কোষ নরম হয়ে গাছ নেতিয়ে পড়ে।
অ্যানথ্রাকনোজ (Anthracnose)
গাছের কাণ্ড, পাতা ও ফলে বসে যাওয়ার মতো দাগ দেখা যায় এবং দাগের মধ্যে কালো কাঁটার মতো জিনিস দেখতে পাওয়া যায়।
ঢলে পড়া (Wilting)
গাছ রোগাক্রান্ত হলে পানির অভাবে গাছ নেতিয়ে পড়ে। এ রোগের প্রথমদিকে গাছের নিচের দিকের কয়েকটি পাতা নেতিয়ে পড়ে, সন্ধ্যাবেলা আবার সোজা হয়ে যায়; এভাবে আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে।
গামোসিস (Gummosis)
এ রোগে ক্ষতস্থান থেকে আঠালো পদার্থ বের হয়। এ আঠা ক্ষতস্থানের চারদিকে শক্ত হয়ে যায়।
পচন (Rot)
): প্রথমে পচে দুর্গন্ধ হয় এবং পরে পচা অংশ শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে যায়। গুড়ি পচা
গুড়ি পচা (Foot Rot)
এ রোগে গাছের গোড়ার দিকটা আক্রান্ত হয়ে বাদামি কালচে রঙের দাগ পড়ে। এর ফলে গাছ আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।
পাউডারি মিলডিউ (Powdery mildew)
পাতার ওপরে বিক্ষিপ্ত সাদা পাউডার আকৃতির দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত অংশ সাদা খড়িমাটির মতো মনে হয়।
হাইপারপ্লাস্টিক লক্ষণ
অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি এবং ফলে কোষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে গাছের কোনো অংশ ফুলে উঠাকে হাইপারপ্লাস্টিক লক্ষণ বলে।
স্ক্যাব (Scab)
এ রোগে গাছের ত্বক ফেটে খসখসে হয়ে যায়।
গল (Gall)
রোগাক্রান্ত অংশের কোষ দ্রুত বৃদ্ধির ফলে স্ফীত হয়ে গোলের সৃষ্টি হয়।
শিকড় গিঁট (Root Knot)
আক্রান্ত কোষটিই ফুলে উঠে স্ফীত হয়।
ডাইনির ঝাঁটা (Witches Broom)
এ রোগে কাণ্ডের আগায় ঘন ঘন ঊর্ধ্বমুখী শাখা উৎপন্ন হয়ে ঝাঁটার আকার ধারণ করে।
ফ্যাসিয়েশন (Fasciation)
পাশাপাশি অঙ্গসমূহ একত্রে বৃদ্ধি পেয়ে চ্যাপটা আকার ধারণ করাকে ফ্যাসিয়েশন বলে। যেমন- গুচ্ছমাথা।
হাইপোপ্লাস্টিক লক্ষণ
কোষ বিনষ্ট বা কোষ বিভাজনের মন্থরতার দরুন গোটা গাছের বা গাছের কোনো অংশের বৃদ্ধির মন্থরতার লক্ষণকে হাইপোপ্লাস্টিক লক্ষণ বলে।
ক্লোরোসিস
বিভিন্ন অংশে স্বাভাবিক সবুজ রং ধারণ না করাকে ক্লোরোসিস বলে।
মোজাইক
পাতায় গাঢ় ও হালকা সবুজ, হলুদ ও সাদা বর্ণের টিস্যু পাশাপাশি থেকে যখন মোজাইকের মতো ডিজাইন হয়।
শিরা স্বচ্ছতা
পাতার শিরা ও উপশিরার সবুজ রং নষ্ট হয়ে হয়ে গেলে স্বচ্ছ এ রং প্রকাশ পায়।
ছিটে দাগ:
পাতার উপর গাঢ় ও হালকা সবুজ বা হলুদ রঙের ফুটফুটে দাগ পড়ে।
প্যাকারিং
এ রোগে শিরা ও উপশিরার মাঝের টিস্যু স্বাভাবিকভাবে বাড়ে কিন্তু সে অনুপাতে শিরা বা উপশিরা গঠিত হয় না।
বামনত্ব
গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে গাছ বামন আকৃতির হয়।
রোজেটিং
গাছের আগার দিকের পাতা স্বাভাবিকভাবে না বেড়ে অনেক পাতা একস্থানে গুচ্ছাকারে অবস্থান করে।