আম ফলের রাজা এবং আমাদের দেশের জাতীয় গাছ হচ্ছে আমগাছ। মধু মাসের অন্যতম প্রিয় ফল আম। স্বাদ এবং সুঘ্রাণের জন্যই আমকে ফলের রাজা বলা হয়। ইতিহাসের ঠিকুজি বিচারে জানা যায়, বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু আম এই উপমহাদেশেই জন্মে থাকে। আমের জন্মস্থানও এই উপমহাদেশেই। বর্তমানে আম আফ্রিকা, মেক্সিকো এমনকি আমেরিকাতেও চাষ হচ্ছে। শুধু মুখরোচকের বিচারেই নয়, পুষ্টিগুণের বিচারেও আম তুলনাহীন। সুপরিপক্ব ভালো জাতের আম যেমন মুখরোচক, তেমনি বলবর্ধক এবং পুষ্টিকর। প্রতি কেজি ফল থেকে ৫০০ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা ফলের মধ্যে থাকে:
পুষ্টি উপাদান | পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ |
আমিষ বা প্রোটিন | ০.৫ ভাগ |
চর্বি বা ফ্যাট | ০.১ ভাগ |
খনিজ পদার্থ | ০.৫ ভাগ |
শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট | ১১.৯ ভাগ |
ক্যালসিয়াম | ০.০১ ভাগ |
ফসফরাস | ০.০২ ভাগ |
লৌহ বা আয়রন | ০.৩ ভাগ |
ভিটামিন এ, বি এবং সি | পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে |
আমাদের দেশের মাটি, আবহাওয়া, জলবায়ু আম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আবহাওয়াগত কারণে রাজশাহী অঞ্চলে আমের চাষ বা আমের উৎপাদন খানিকটা বেশি হলেও কমবেশি দেশের সব অঞ্চলেই আমের চাষ করা যায় বা আমের চাষ হয়ে থাকে। আমাদের দেশের একটা বড় চাহিদা এখন পূরণ হচ্ছে পার্বত্য তিন জেলা (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) থেকে।
আপনার মনে স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, আমগাছ বিশাল আকারের একটা বৃক্ষ, সুতরাং এখানে কীভাবে একটা ছাদের ওপরে একখানা আমগাছ লাগানো যাবে? এখানেই কৃষিবিজ্ঞানীদের সফলতা। বস্তুত এখন পৃথিবীব্যাপী হাজারেরও বেশি প্রজাতির আমের চাষ হয়। এটা নিয়ে আমাদের দেশেও বিস্তর গবেষণা করা হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো বেশ কিছু বামন জাতের হাইব্রীড আমগাছ হাফ ড্রামে করে ছাদের ওপরে অনায়াসে চাষ করতে পারি।
আমের জাত:
বাংলাদেশে অনেক জাতের আম দেখা যায়। তার মধ্যে জনপ্রিয় জাতগুলো হলো ল্যাংড়া, হিমসাগর, বোম্বাই গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত, ফজলি, আম্রপালি ইত্যাদি। খুলনা বিভাগের আমসমৃদ্ধ জেলা মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলায় যেসব আম জাতের চাষাবাদ বর্তমান সময়ে হচ্ছে সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানে রয়েছে ফজলী, ল্যাংড়া, হিমসাগর, আম্রপালী, মল্লিকা, বারি আম-৪, বোম্বাই (গ্রেট বোম্বাই, ভূতে বোম্বাই, তিলে বোম্বাই), মোহনভোগ, কোহিতুর, বিশ্বনাথ, রানিপছন্দ, সিদুরেখাস, বা সরিখাস, মধুগুলগুলো ইত্যাদি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এ যাবৎ আমের বেশ কিছু নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ফল গাছ উন্নয়ন প্রকল্প (Fruit Tree Improvement Project or FTIP) হতে এ যাবৎ নানান ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেকগুলো নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। অধিকন্তু, আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় আমের জাতের আমাদের দেশে নানাভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং সেসব জাতের বেশ কিছু জাত আমাদের দেশে বেশ ভালো ফলনও দিয়ে যাচ্ছে। যেভাবেই আসুক না কেন কোন আমের জাত যদি আমাদের দেশে এসে ভালো ফলন দেখাতে পারে, তাহলে সেসব জাতসমূহকে আমরা আমাদের দেশের জনপ্রিয় আমের জাত হিসেবেই বিবেচনা করব।
বিভিন্নভাবে আনীত এ ধরনের কিছু আমের জাতের নাম নিচে দেওয়া হলো: আলফানসো, অমৃতভোগ, আনোয়ারা, বৈশাখী, আনোয়ার আতাউল, ভূতে বোম্বাই, বিশ্বনাথ চ্যাটার্জী, চৌষা, ক্ষুদি, ক্ষিরসা, কোহিতুর, আতরগন্ধ, দশেরী, অমৃতভোগ, বৃন্দাবনী, বীরা, দ্বারভাঙা, চন্দনকোষ, কমলা সুন্দরী, রাজভোগ, তোতাপুরী, টিক্কা ফরাস, সাটিয়ার কারা, গোলাপ বাঁশ, কুয়া পাহাড়ি, বাগানপালী, সফেদা, রাঙ্গুয়াই, কালুয়া, কালীভোগ, গৌরজিৎ, দুধস্বর, বৃন্দাবনী, অগ্নি, আলমপুরি, বেনিসান, নীলমনি, বেগমফুলি, বাতাসা, বুধিয়া, চাপড়া, চিনিপাতা, মানিকজোড়, নীলা, পাতাপুরী, সুবর্ণরেখা, আলম শাহী, চম্পা, ফনিয়া, ইলশা পাটি, কাঞ্চন কশাই, মালগোভা, নারিকেল পাখি, রাজাপুরী, রসুনটাকি, সরবতী, সিঙ্গাপুরী, জাফরান, চাক চাকিয়া, চাপড়া, গুটি, কোম্পানি, লাডুয়া, মালদা, মতিচুর, রোগনী, সিন্দুরী, সুরখা, নীলমনি, ভবা, হলদে মণি, কৃষ্ণচূড়া, পেটা সুইট, রোমালী, সীতাভোগ, সোরিখাস, শ্যামলতা, বৌ ভুলানী ইত্যাদি।
.
হাইব্রিড জাতসমূহ : একটা জাতের আমের সাথে আরেক জাতের আমের সংকরায়ন করার পরে প্রথম যে প্রজাতি (F1) তৈরি হয় সেটাকে বলে হাইব্রীড জাতাংকরায়ন আমের হাইব্রীড জাতের সুফল পেতে অনেক বছর সময় লাগে। নিচে কিছু হাইব্রীড জাতের নাম দেওয়া হলো। নিচের এসব হাইব্রীড জাতের বেশিরভাগই এসেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। বিক্ষিপ্তভাবে এসব হাইব্রীড জাতের কিছু কিছু জাতও এখন আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে। এসব জাতের ডান পাশে ব্রাকেট বন্ধনীর মধ্যে তাদের মাতৃ ও পিতৃ গাছের নামও সন্নিবেশ করা হলো। • আম্রপালি (দশেরী x নীলম)
- মল্লিকা (নীলম x দশেরী)
- আল ফজলি (আলফানসো X ফজলী)
- সুন্দর ল্যাংড়া (ল্যাংড়া x সুবিধর পছন্দ)
- আরকা অরুনা (বাগানপল্লী এক্স আলফানসো)
- আরকা পুনিত (আলফানসো এক্স বাগানপল্লী) মঞ্জীরা (রুমানী x নীলম)
- রত্না (নীলম x আলফানসো) সিন্দু (রত্না x আলফানসো)
- সাবরী (গোলাপখাস x বোম্বাই) নীল উদ্দিন (নীলম x নুয়ামদ্দিন)
- শংকর ২০-৮ (নীলম x আলফানসো) ত্রিমোহনী (মল্লিকা x ভ্যাসতারা)
- ত্রিজুত (বেনীসান x আম্রপালি) • নীলেশান (নীলাম x †বনীসান)
- পুষা সুরাইয়া (সেনসেশান x আম্রপালি)
- পুষা অরুনিমা (আম্রপালি x সেনসেশান)
আমরা হয়তো আমাদের ঐতিহ্যবাহী ল্যাড়া, হিমসাগর, বোম্বাই, ফজলী হয়তো ছাদে চাষ করতে পারব না কিন্তু অনেক জাতের আমই এখন ছাদ বাগানে চাষ করা সম্ভব। আমাদের দেশে যে সকল আমের জাত পাওয়া যায় এসব জাতের মধ্যে হাফ ড্রামে যেসব জাতের আমের চাষ করা যায়, সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বারি আম-৩ বা আম্রপালি, মল্লিকা, বাউ আম-২, বাউ আম-৩, বাউ আম-৬, বাউ আম-৭, বাউ আম-৯ (চৌফলা), বারি আম-৪, বারি আম-১১ (বারোমাসি), ব্যানানা আম, লতা বোম্বাই, থাই বারোমাসি বা কার্টিমন ইত্যদি। টবে ছাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী জাত হচ্ছে আম্রপালি এবং থাই বারোমাসি বা কার্টিমন আবার শৌখিনতার কারণে আপনি বাউ আম-৯ (চৌফলা) এবং বারি আম-১১ (বারোমাসি) আমের কয়েকটি চারা লাগাতে পারেন।
ছাদে আমের কলম লাগানোর পদ্ধতি :
ছাদে আমের চারা/কলম লাগানোর জন্য হাফ ড্রাম অথবা সিমেন্টের পট বা জিও ব্যাগ নিয়ে তাতে এই বইয়ের “ছাদ বাগানের জন্য মাটি প্রস্তুত ও চারা রোপণ” অধ্যায়ে ছাদ
বাগানের জন্য “ছাদ বাগানের জন্য আদর্শ মাটি তৈরি করত সেখানে আমগাছের কলম রোপণ করতে হবে। চারা গাছটিকে সোজা করে সঠিকভাবে রোপণ করতে হবে। তারপর গাছের গোড়ায় মাটি কিছুটা উঁচু করে হাত দিয়ে মাটি চেপে চেপে দিতে হবে। ফলে গাছের গোড়া দিয়ে পানি বেশি ঢুকতে পারবে না। একটি সোজা চিকন লাঠি দিয়ে গাছটিকে বেঁধে দিতে হবে। চারা রোপণের শুরুর দিকে পানি অল্প দিলেই চলবে। পরে ধীরে ধীরে পানি দেওয়া বাড়াতে হবে। তবে গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না। মাটিতে রসের ঘাটতি দেখা দিলে প্রয়োজনমতো গাছে সেচ দিতে হবে। তবে বর্ষাকালে আম কলম রোপণ করলে কোনো পানি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
অন্যান্য পরিচর্যা : বিভিন্ন পরিচর্যা সহ প্রতিবছর দু’বার সার প্রয়োগের জন্য “ছাদ বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা” অধ্যায়ের খুঁটিনাটি অনুসরণ করুন। আমগাছে ফুল ও ফল ধারণ সম্পর্কিত কতিপয় বিবেচ্য বিষয়াবলি:
মুকুল বের হওয়ার সময়:
আমগাছে কখন মুকুল আসবে তা নির্ভর করে আমগাছের বংশগতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপরে। শীতের তারতম্যের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগে পৌষ-মাঘ মাসে এবং রাজশাহী বিভাগে মাঘ-ফাল্গুন মাসে আমের মুকুল আসে। আবার অব-উষ্ণ অঞ্চলে বারোমাসি জাতে একাধিকবার ফল ধরলেও অন্যান্য জাতে মাত্র একবার মুকুল আসে। আবার যে সকল জাতে বছরে একবার মুকুল আসে, সে সকল জাত ভারতের কন্যাকুমারী দ্বীপে (উষ্ণ অঞ্চল) লাগালে একাধিকবার ফল আসে। একটা গাছে পুষ্পমঞ্জুরি বের হওয়া থেকে শুরু করে মুকুল আসা শেষ হতে প্রায় একমাস সময় লাগে এবং এর মধ্যে ২/৩ বার পুষ্পমঞ্জুরি বের হয়। জাতভেদে পুষ্পমঞ্জুরি বের হওয়া থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত ৪-৬ মাস সময় লাগে। পরাগায়ন ও ফল ধারণ:
আমের পুষ্পমঞ্জুরিতে সাধারণত পুরুষ ফুল এবং উভয়লিঙ্গ ফুলের আধিক্য দেখা যায়। বেশি ফল ধারণের জন্যে বেশি মাত্রায় উভয়লিঙ্গ ফুল থাকা আবশ্যক। তবে আমগাছে পর পরাগায়ন বেশি হয়ে থাকে। ভারতের কোনো কোনো জাতের আমগাছে স্বীয় পরাগরেণু দ্বারা পরাগায়ন হয় না। আবার পরাগায়নের জন্যে শীতকালে মাছিদের আনাগোনা কম থাকে বলে নাবি জাতের গাছে আমের ফলন ভালো হয়।
ফল ঝরে পড়া:
ফল ঝরে পড়া প্রকৃতির নিয়ম। হিসাবে দেখা গেছে, আমগাছে খুঁটি আসার পরে প্রথম চার সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি ফল ঝরে পড়ে। বোম্বাই, ল্যাংড়া, হিমসাগর জাতের আমগাছে ১৩-২৮ উভলিঙ্গ ফুলে ফল আসে এবং এর মধ্যে আবার ১০-২৫% ফল টিকে থাকে। তবে হালে এসে কিছু কিছু রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে কিছুটা উপকার পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ভারতীয় আম দোশোহরীতে আমগুঁটি বৃদ্ধির প্রাথমিক অবস্থায় ২% হারে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
অনিয়মিত ফল ধারণ:
আমগাছে অনিয়মিত ফল আমগাছের একটা বিশেষ ধরনের জাত বৈশিষ্ট্য। নিয়মিত জাতের আমের গাছেও (আম্রপালি, মল্লিকা, নীলাম, তোতাপুরী) এক বছর বেশি ফল ধরলে পরের বছরে কম ফল ধরে থাকে। এটা নির্ভর করে আমের জাত, আবহাওয়া এবং জলবায়ু, আম বাগানের অবস্থান এবং আম বাগান পরিচর্যার ওপরে। অনিয়মিত ফল ধরে এমন জাতের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যার সমাধান খুব কঠিন হলে আম পাকার ২ সপ্তাহ আগে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে এটাকে কিছুটা কমানো যেতে পারে। এটা করলে আমগাছের বৃদ্ধি ১২ মাসের মধ্যে সীমিত রাখা যায়। আবার নিয়মিত ফল ধরে এমন জাতের গাছ যদি অনেকদিন জলাবদ্ধ অবস্থায় থাকে তাহলে নিয়মিত ফল ধরা ব্যাহত হবে। আবার একইভাবে যদি আম সংগ্রহের পরপরই বৃষ্টি না হয় তাহলেও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। সুতরাং, এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। আবার আম বাগানের মাটি যদি অধিক উর্বর হয় এবং মাটিতে পানির উচ্চতা বেশি হয় অথবা আম বাগানে খুব বেশি ছায়া পড়ে, তাহলেও অনিয়মিত ফল ধরতে পারে; সুতরাং এ বিষয়টি সতর্কতার সাথে ম্যানেজ করতে হবে।
আমগাছ বৃদ্ধির ধরন:
আমগাছের বৃদ্ধি ক্ষণে ক্ষণে হয়ে থাকে, তবে নতুন গাছের বৃদ্ধি অবিরাম গতিতে চলতে থাকে। আমগাছের প্রান্ত শাখায় ফুল এবং ফল ধরে, তবে ফুল এবং ফল ধরলে সে সময় আর বৃদ্ধি হয় না। ফলন্ত আমগাছে স্বাভাবিক সুপ্তাবস্থা বিরাজ করে। এরপর নতুন ডালপালা ছেড়ে হঠাৎ করে বাড়তে থাকে। এই বাড়াকে বলে দীপ্তি বা Flush | এখন এই দীপ্তি বছরে কয়বার হবে সেটা ঐ জাত, গাছের বয়স, গত বছরে কেমন ফল ধরেছে, আবহাওয়া প্রভৃতির ওপরে নির্ভর করে থাকে; সাধারণত ৩/৫ বার দীপ্তি আসে। কোনো আমগাছে যদি কোনো বছর ৮০% প্রান্ত শাখায় ফল দিয়ে থাকে তাহলে ঐ গাছটির জন্যে ঐ বছরকে বল হবে On Year আর যদি পরের বছরে বাকি ২০% ফল ধারণ করে থাকে তবে পরের বছরকে বলা হবে Off Year; সুতরাং আমগাছে পুরো ফল আসতে দুবছর সময় লেগে যাবে।
ফল ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় খাবার:
আমগাছে ফল ধারণের জন্যে প্রচুর পরিমাণে খাবার দরকার; এসব খাবারের মধ্যে আছে স্টার্চ, মোট শর্করা এবং C:N এর পর্যাপ্ততা। এসব খাবার জমা থাকে গাছের পাতার মধ্যে। আমগাছে On Year-এ এসব খাবার প্রচুর ব্যবহৃত হয়ে থাকার কারণে পরের বছরে খাবার কমে যায়। এজন্যে গাছ আবার খাবার সংগ্রহের জন্যে Off Year-এ পাতা সৃষ্টি করে। আর নিয়মিত ফল ধারণসম্পন্ন গাছে ফল ধারণের পরপরই গাছে নতুন পাতা দেখা দেয় পরের বছরের জন্যে খাবার সংগ্রহের লক্ষ্যে।
পুষ্পমঞ্জুরি তৈরিতে হরমোনের প্রভাব:
বড় গাছের পাতায় এক ধরনের হরমোন থাকে যা মুকুল বের হতে সহায়তা করে। অন্যদিকে গাছের কচিপাতায় মুকুলরোধী অক্সিন এবং জিবারেলিন থাকার জন্যে মুকুল আসা প্রতিহত করে। সাধারণত প্রান্ত শাখার বয়স ও পরিপক্বতার ওপরে মুকুল উদ্বুদ্ধকরণ (Flower Inducing) হরমোনের পরিমাণ নির্ভর করে। নিয়মিত ফল ধরে এমন জাতের কচিপাতাও মুকুল উদ্বুদ্ধকরণ (Flower Inducing) হরমোন তৈরি করতে সক্ষম। আবার Off Year-এ গাছের প্রান্ত শাখায় প্রচুর পরিমাণে জিবারেলিন হরমোন থাকে, কারণ On Year জিবারেলিন হরমোন প্রয়োগ করলে মুকুল আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই Off Year-এ অ্যান্টি জিবারেলিন কম্পাউন্ড প্যাক্লোবিউট্রাজল ব্যবহার করলে ভালো রেজাল্ট আসে।
আবহাওয়ার প্রভাব:
খুব কম তাপমাত্রা আমগাছের ফলের পরাগায়ন ব্যাহত করে, এমনকি কখনো তাপমাত্রার কারণে On Year পরিণত হয়ে যেতে পারে Off Year-এ। মুকুল বের হওয়ার সময় বৃষ্টি হলে গাছে নতুন পাতা বেরিয়ে যেতে পারে। মুকুল বের হওয়ার জন্যে মুকুল আসার আগে গাছে কিছুটা স্ট্রেস দরকার, যেমন মুকুল আসার আগে সেচের স্বল্পতা এবং শীত শীত ভাব এ ধরনের স্ট্রেসে সহায়তা দিয়ে থাকে। আবার কোনো কারণে On Year যদি Off Year-এ পরিণত হয় তাহলে পরের বছর হতে প্রকৃত On Year বদলিয়ে যেতে পারে। পুষ্পমঞ্জুরি তৈরিতে কৃত্রিম হরমোনের প্রয়োগ ও প্রভাব:
কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগ করলে দেখা যায় Off Year-এ ফল ধারণ করে সত্য, তবে গাছের সঞ্চিত খাদ্য ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গাছ দুর্বল হয়ে যায় এবং গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অন্যদিকে গাছে এসব হরমোনের মাত্রার একটু হেরফের হলে গাছের পাতা পড়ে যায়, ফলে উল্টো ফল হয়। আবার কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগের সময়টিও সুনির্দিষ্ট না হলে ফল ধারণ ব্যাহত হয়।
আমের ক্ষতিকর পোকামাকড় ও তাদের দমন ব্যবস্থাপনা:
শোষক বা হপার পোকা:
আমগাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে চটচট শব্দে যে পোকা আমাদের গায়ে পড়ে, সেটাই শোষক বা হপার পোকা। এই পোকার প্রধান খাবার হলো আমের মুকুলের রস; ফলে এই পোকা আমের মুকুলের রস খাবারের পাশাপাশি সেই সময় তাদের বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। এছাড়া এ পোকা আম্র মুকুলের রস খেয়ে, বিষ্ঠা ত্যাগ করে আঠালো ধরনের মধুরস, যার সাথে ফলের পরাগরেণু আটকে গিয়ে পরাগায়ন ব্যাহত হয় এবং এ রসের সাথে ছত্রাক জন্মে কালো হয়ে যায়, যাকে বলে “মহালাগা”। এ পোকার রাসায়নিক দমন হিসেবে আমরা বাজারে প্রচলিত জৈব বালাইনাশক বা সাইপারমেথিন বা ডেল্টামেথ্রিন জাতীয় কীটনাশকসমূহ অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে পারি।
চিত্র: আমের হপার পোকা
এসব কীটনাশক উল্লেখিত মাত্রায় গাছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে কিন্তু ফুল ফোটার আগে একবার এবং এর একমাস পর আরেকবার সমগ্র গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালায় ভিজিয়ে দিতে হবে।
ভোমরা বা ফল ছিদ্রকারী পোকা:
এ পোকা আমের গায়ে ছিদ্র করে আমের মধ্যে প্রবেশ করে আমের শাঁস খেয়ে থাকে। এ পোকার আক্রমণ শুরু হয় আম মটরদানার মতো হলে। কচি আম ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, ফলে আমের গায়ের সেই ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। এজন্যে বাইরে থেকে এ আম চেনা বড্ড কঠিন। একবার এ ধরনের পোকার আক্রমণ হলে প্রতিবছর সেটা হতে থাকে এবং আশেপাশের গাছেও এ পোকা ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবস্থাপনা হিসেবে জৈব বালাইনাশক বা ইমিডাক্লোরোপিড জাতীয় কীটনাশক ১৫ দিন পরপর স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। প্রথম স্প্রে করতে হবে আম মটরদানা বাঁধার পরে।
চিত্র: ভোমরা বা ফল ছিদ্রকারী পোকা
আমের মাছি পোকা:
আম পাকার সময়ে এ পোকা আমের গায়ে ডিম পাড়ে, অতঃপর ডিম ফুটে অসংখ্য কীড়া আমের শাঁস খেয়ে ফেলে; পাকা আম কাটলে এ পোকার কীড়া দেখা যায়। আম পাকার একমাস আগে এ পোকা দমনের জন্যে ১৫ দিন পরপর দুইবার ভালো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত জৈব বালাইনাশক স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
চিত্র: আমের মাছি পোকা
অ্যাপসিলা পোকা : মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা। পোকার আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি ও আমের উৎপাদন কমে যায়। কচিপাতার ভিতর থাকা প্রথম ধাপের নিম্ফ পাতার ভিতর থেকে রস চুসে খায় এবং এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে, যার কারণে পত্রকক্ষে সুচালো মুখবিশিষ্ট সবুজ রঙের মোচাকৃতি গলের সৃষ্টি হয়। গল সৃষ্টি হওয়ার কারণে পত্রকক্ষে আর কোনো নতুন পাতা বা মুকুল বের হতে পারে না। গাছে বেশি পরিমাণে গল সৃষ্টি হলে গলযুক্ত ডগা শুকিয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা:
আক্রান্ত ডগা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে আগস্ট মাসে ১৫ দিন পরপর ২ বার প্রবহমান কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
আমের ক্ষতিকর রোগ ও তাদের দমন ব্যবস্থাপনা:
আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ:
এ রোগের আক্রমণে আমের পাতা, কাণ্ড, মুকুল ও ফলে ধূসর বাদামি রঙের দাগ পড়ে। মুকুল ঝরে পড়ে, আমে কালচে দাগ হয় এবং আম পচে যায়। প্রতিকার হিসেবে আমের মৌসুম শেষে মরা ডালপালা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছের নিচের মরা পাতা পুড়িয়ে দিতে হবে। গাছে মুকুল আসার পরে এবং ফুল ফোটার আগে কার্বেন্ডাজিম বা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক বা জৈব ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় পানির সাথে মিশিয়ে (প্যাকেট বা বোতলের গায়ে লিখিত ও নির্দেশিত মাত্রায়) স্প্রে করতে হবে। আমের আকার মটরদানার মতো হলে আরেকবার স্প্রে করতে হবে।
পাউডারী মিলডিউ রোগ:
ছত্রাকজনিত এ রোগে আমের মুকুল সাদা পাউডারের মতো হয়ে পড়ে, মুকুল ঝরে পড়ে, আমের চামড়া খসখসে হয় এবং আম কুঁচকে যায়। আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের ক্ষেত্রে যে ধরনের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে সেটা অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
আমের বিকৃতি:
রোগটি ভারতে বড় সমস্যা হলেও এদেশে তেমন বড় সমস্যা নয়। তবে ক্ষিরসাপাত, আম্রপালি এবং লতা বোম্বাইতে এ রোগের কিছুটা আক্রমণ দেখা যায়। এ ধরনের বিকৃতি দুই প্রকার- (১) দৈহিক বিকৃতি (২) মুকুলের বিকৃতি। একদল বিজ্ঞানীর মতে
এটি শারীরবৃত্তীয় রোগ আবার অন্যদলের মতে এটি ভাইরাস বা মাকড়জনিত রোগ। সর্বশেষ দলের বিজ্ঞানীর মতে এটি ছত্রাকজনিত রোগ। বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এ ছত্রাক দ্বারা রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা প্রমাণ করেছেন।
দৈহিক বিকৃতি
মুকুলের বিকৃতি
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত চারা গাছ ও মুকুল কেটে ফেলতে হবে। কলম তৈরিতে সুস্থ রুট স্টক ও সুস্থ সায়ন ব্যবহার করতে হবে। কার্বেন্ডাজিম বা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাশনাশক বা জৈব ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় পানির সাথে মিশিয়ে (প্যাকেট বা বোতলের গায়ে লিখিত ও নির্দেশিত মাত্রায়) স্প্রে করতে হবে। গাছে মুকুল আসার আগে গ্রোথ হরমোন স্প্রে করলে মুকুলের বিকৃতির হার কমে যায়। সেই সাথে আমের মুকুল বেশি আসে এবং বেশি ফলন পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং গ্রোথ হরমোন ব্যবহারের দ্বিবিধ উপকারিতা রয়েছে।
কলমের প্রাপ্তিস্থান : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টারসমূহ, বিএডিসি’র এগ্রো সার্ভিস সেন্টার ও বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন জাতের আমের কলম পাওয়া যায়। আবার বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছ থেকেও আমের কলম সংগ্রহ করতে পারেন।
আমাদের ফেসবুক পেজ = Siraj Tech Facebook
ছাদ বাগান করার জন্য জিও ব্যাগের অর্ডার করতে 👉 Geo Grow Bag
দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন ধরনের সুন্দর সব ফল ও শাক-সব্জির বীজ পাবেন আমাদের কাছে। 👉 High Quality Gardening Seeds
ছাদ বাগানের বিভিন্ন সরঞ্জাম। 👉 High Quality Gardening Tools
গাছের জন্য বিভিন্ন জৈব কীটনাশক। 👉 Organic Fertilizers and Pesticides
নদী ও পুকুরের পাড় ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাগ ও জিও রোল। 👉Geobag Geotube and Geosheet